প্রযুক্তি! বিশেষ করে স্মার্টফোন ছাড়া এখন একটি ক্ষণও কল্পনা করা যায়না। কিন্তু আমরা কি জানি এর কারনে বাড়ছে ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া বা ডিজিটাল স্মৃতি লোপ হওয়া রোগ। যত দিন যাচ্ছে মানুষ এই সমস্যায় আরও পতিত হচ্ছে। জনপ্রিয় অভিনেতা আমির খান অভিনিত গাজনি সিনেমার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে! তার মাথায় আঘাত পেয়ে সব ভুলে যায়, তারপর প্রয়োজনীয় সব তথ্য নিজের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লিখে ঘুরে বেড়ায়।
বাংলা নাটক সিনেমা ও সাহিত্যে এই সব উদাহরন প্রায়ই দেখা যায়। বাংলাদেশি অনেক সিনেমাতে দেখা যায় নায়কের মাথায় আঘাত করলে সে স্মৃতি হারিয়ে ফেলে! মাথায় আঘাত লাগলে স্মৃতি চলে যাওয়ার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হলেও, গবেষকরা স্মৃতি হারিয়ে ফেলার একটা অত্যন্ত পরিচিত কারণ বলে দিয়েছে।
আর সেটি হলো- বেশি বেশি মোবাইল ফোন বিশেষ করে স্মার্টফোন ব্যবহার করা। অবাক হচ্ছেন শুনে? স্মার্টফোন ব্যবহারে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, বিষণ্নতায় ভোগা, কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ার কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু স্মার্টফোনের কারণে যে আমাদের স্মৃতিশক্তিও হারিয়ে যাচ্ছে যার নাম ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া, তা জানা নেই অনেকেরই।
ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া

এই ভুলে যাওয়া রোগের নাম হচ্ছে ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই আর্টিকেল আপনি আপনারা ফোনেই দেখছেন, আবার ৮০ পার্সেন্ট চান্সও আছে এই আর্টিকেল এর টপিকটিও আপনারা হয়তো ভুলে যাবেন। হাতের স্মার্টফোন পেলে আমরা একেক জন যেন তথ্য সম্রাট হয়ে যাই।
কোন কিছু জানতে হলে প্রথমেই আমরা গুগলে সার্চ করি, অথচ ঘাড়ের উপরে যে মস্ত বড় মাথা আছে, এটা মনে থাকে না আমাদের। আজকাল আমরা ফোনের উপর এত বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি যে পরের দিন সকালে উঠে কোন কাজটি আগে করব সেটা জানার জন্য ফোনের নোটের উপর ভরসা করতে হচ্ছে।
কার বার্থডে কবে, কোন দিন কোথায় মিটিং— সবকিছুই সেট করে রাখছি ফোনের ক্যালেন্ডারে। মাথার কাজ দিয়ে দিচ্ছি মোবাইল ফোনকে, ফলে আমাদের মাথার ভেতরকার স্মৃতি ক্ষমতা দিনদিন কমে যাচ্ছে।
গুগল ইফেক্ট
আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগে, আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনের একটি গবেষণায় প্রযুক্তির অত্যাধিক ব্যবহারের ফলে যে মানুষের স্মৃতিশক্তি হুমকির মুখে পড়ে, তা প্রথম জানা যায়। তারপর হার্ভার্ড, কলম্বিয়া এবং উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তরুণদের উপর প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
গবেষণার ফলাফল খুবই ইন্টারেস্টিং, যার নাম দিয়েছে “গুগল ইফেক্ট”। গবেষণায় দেখা যায় সার্চ ইঞ্জিনে যেসব তথ্য সহজে পাওয়া যায়, তা মানুষ সহজে ভুলে যায়। এটিকে এক ধরনের ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া বলা হয়।
অ্যামনেশিয়া মানে হলো স্মৃতি হারানো। আর ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া মানে হচ্ছে ডিজিটাল ডিভাইসের উপর অতি নির্ভরতার কারণে ওই স্মৃতিগুলো নিজে মনে রাখতে না পারা। ক্যাসপারস্কির নাম তো সবাই শুনেছেন—ওই যে কম্পিউটারের অ্যান্টিভাইরাস বানায় যারা।
এটা মূলত একটি রাশিয়ান কোম্পানি। ২০১৫ সালের দিকে এই ক্যাসপারস্কি কোম্পানি ৬০০০ মানুষের উপর গবেষণা চালিয়ে দেখে যে যখন তথ্য সহজে পাওয়া যায়, তখন মানুষের ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। গবেষণায় আরো দেখা যায় মানুষ স্মার্টফোনে থাকা আত্মীয়-স্বজন, এমনকি বাবা-মায়ের ফোন নম্বরও মনে রাখতে পারছে না।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের বিশেষজ্ঞদের মতে, বয়স ৪০ পেরোলে ধীরে ধীরে স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক। তবে তার আগেই যদি এমন হতে থাকে, তাহলে ব্যাপারটা বেশ টেনশনের। ইনভেস্টর টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে—
বর্তমানে ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী মানুষের স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এবার আসুন এটা কেন হচ্ছে তার টেকনিক্যাল দিকগুলো দেখি। স্মার্টফোন আর সার্চ ইঞ্জিন অনেকটা এক্সটারনাল স্টোরেজের মতো। যতবার আপনি স্মার্টফোন বা গুগল থেকে কোনো তথ্য নিচ্ছেন, ততবারই আপনার ব্রেইন ধরে নিচ্ছে ওই তথ্যটা তার ব্রেইনের নিজস্ব স্টোরেজে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। তখন মস্তিষ্ক অটোমেটিক্যালি নিজের স্মৃতিতে জায়গা না করে এক্সটারনাল স্টোরেজ ব্যবহারকে সুবিধাজনক মনে করে।
ইউনিভার্সিটি অফ সাসেক্স এর কগনিটিভ নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক ব্রিজ বার্ট এই বিষয়ে একটি ইন্টারেস্টিং কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আমরা প্রতি মুহূর্তে ডিজিটাল ডিভাইসে স্মৃতির স্থানান্তর করছি। এখন প্রশ্ন হলো, এভাবে আমরা যদি আমাদের স্মৃতি বাহ্যিক কোনো ডিভাইসে স্থানান্তর করতে থাকি, তাহলে কি ঘটবে ভবিষ্যতে? কি ফোনই ঠিক করে দেবে আমাদের মস্তিষ্ক বা স্মৃতি কিভাবে কাজ করবে?
এই প্রসঙ্গে মন্ট্রিয়লের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অলিভার হার্ট একটি মজার কথা বলেছেন। তার মতে, আমাদের ব্রেইনের মেমোরি সেলগুলো আমাদের শরীরের অন্যান্য পেশির মতোই। আমরা যখন কোনো পেশির ব্যায়াম করি, তখন সেটি ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়। আর যদি নিয়মিত ব্যায়াম না করি, তাহলে সেই পেশিটি দুর্বল হয়ে পড়ে। ঠিক তেমনি আমরা যদি মনে রাখার চেষ্টা বন্ধ করে দিই, তাহলে আমাদের স্মৃতি আরো দুর্বল হবে। এতে ডিভাইসের প্রতি নির্ভরশীলতা আরো বাড়বে। ফলে আমাদের ডিমেনশিয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তাহলে ডিমেনশিয়া কি? ডিমেনশিয়া হলো একটি মানসিক রোগ যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির বুদ্ধি, স্মৃতি ও ব্যক্তিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রোগ প্রবণতা আরো বাড়তে থাকে। সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিরা এ রোগে আক্রান্ত হন এবং হঠাৎ করে অনেক কিছুই মনে করতে পারেন না। ভয়ের ব্যাপারটা হচ্ছে, বর্তমানে বয়স্কদের পাশাপাশি তরুণরাও ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।
কেন এবং কিভাবে হচ্ছে? ওই যে একটু আগেই বলছিলাম ব্যায়ামের কথা। যে পেশির ব্যায়াম করবেন, সেটি বেশি শক্তিশালী হবে। আর না করলে উল্টোটা হবে। মনে আছে? এবার আসুন দেখি বিশেষজ্ঞরা কি বলছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষ নিজের মনকে যত কম ব্যবহার করে, ততই এপিসোডিক মেমোরি, কগনিটিভ ফ্লেক্সিবিলিটির মতো জটিল কাজগুলো করার জন্য মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় সিস্টেমের ব্যবহার করা হয় না। তবে ভয়ের কিছু নেই। উদাহরণ দিয়ে বললেই বুঝবেন।
ধরুন, কোনো স্থানের মানচিত্র মনে রাখতে মস্তিষ্ককে যে জটিল কাজ করতে হয়, স্মার্টফোনের কারণে তার শিকিভাগও করতে হয় না। মানচিত্র পড়া ও বোঝা একটি কঠিন কাজ। আর তাই আমরা সহজেই এগুলোকে স্মার্টফোনের উপর চাপিয়ে দিয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়ি।
গবেষণায় দেখা যায় আমাদের ব্রেইন মাল্টিটাস্কিং পারে না। আপনাদের মনে হতে পারে মাল্টিটাস্কিং সম্ভব। আপনি যখন ড্রাইভ করছেন, তখন হয়তো এফএম রেডিওতে গান শুনতে পারবেন। কিন্তু আপনি যদি ড্রাইভ করতে করতে ফোনে মনোযোগ দেন, তখন আপনার পক্ষে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগী হওয়া সম্ভব নয়। এর কারণে সারা পৃথিবীতে প্রচুর অ্যাক্সিডেন্ট হচ্ছে।
আপনি কোনো কাজে মনোযোগ না দিলে, সেই কাজের স্মৃতি আপনার মস্তিষ্কে জমা হবে না।
ব্যাপারটা সিম্পল। ডিজিটাল ডিমেনশিয়া তো না হয় বুঝলাম, কিন্তু এর প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে সেটা কি জানেন? ডিজিটাল ডিমেনশিয়ার প্রভাব অলরেডি আপনার সন্তানের উপরে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে, যেসব শিশু প্রযুক্তি বেশি ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্কের কর্টেক্স—মানে ব্রেনের যে অংশে আমাদের স্মৃতি জমা রাখার কাজ করে—সেটিকে পাতলা করে দেয়।
বয়স বাড়লে এই অংশ পাতলা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি স্বাভাবিক। কিন্তু ছোটবেলায় এমন হতে থাকলে পারকিনসন, আলঝেইমার, মাইগ্রেন রোগ হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাহলে ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় কি? স্মার্টফোন ছাড়া আধুনিক যুগে চলা আসলেই অসম্ভব। আমাদের প্রয়োজন একটু ব্যালান্স করা।
ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া থেকে রক্ষা পাবেন কিভাবে? মাঝে মাঝে ফোন থেকে একটু দূরে থাকুন। দিনের একটা অংশ আপনার পরিবারকে দিন, তাদের সাথে গল্প করুন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিন। লম্বা ছুটিতে ঘুরে আসুন। এতে করে আপনার ব্রেইন প্রপার রিলাক্সেশন পাবে। এগুলো আমার কথা নয়, বিশেষজ্ঞদেরই কথা।
সেইসাথে আরেকটা কাজ করার চেষ্টা করবেন। ঘুমানোর অন্তত আধা ঘণ্টা আগে ফোন ব্যবহার বন্ধ করুন। প্রয়োজনে নোটিফিকেশন অফ রাখুন এবং আমি যেটা করি, সেটাও করতে পারেন। ঘুমানোর আগে একটি বই পড়ার চেষ্টা করতে পারেন। বই ফোনের থেকে ভালো বন্ধু।
ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া থেকে বাঁচতে বা ফোন থেকে দূরে থাকার জন্য আপনারা কি করছেন সেটা কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। সবাই ভালো থাকুন। নির্বাচনী প্রতীক কীভাবে এলো তার অজানা ইতিহাস জানতে এটি পড়ুন।
বিষয়টি আরও ভালোভাবে বুঝতে চাইলে নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেন-
2 Comments
Pingback: খারাপ অভ্যাস দূর করার সহজ ও কার্যকর কৌশল - NiceTrix
Pingback: কথা বলার ৫টি কৌশল অবলম্বন করলে শ্রোতা মুগ্ধ হতে বাধ্য! - NiceTrix