বাংলাদেশসহ বিশ্বের গণতান্ত্রিক প্রায় সকল দেশেই নির্বাচন ব্যবস্থা চালু আছে। সব ক্ষেত্রেই নির্বাচনী প্রতীক এর মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করা হয়। কখনো কি আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে কোথা থেকে এসেছে এই সব পদ্ধতি?
ভারতের কংগ্রেস, বিজেপির মতো দলগুলো বেশ কয়েকবার নিজেদের নির্বাচনী প্রতীক পাল্টেছে। বাংলাদেশে যদিও এই ধরণের ঘটনা এখনো ঘটেনি তবে স্বাধীনতার পর আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম বদলে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ হয়েছে।
খেয়াল করেছেন দেখেছেন নিশ্চই, বেশিরভাগ দেশেই প্রতীক দেওয়া হয় সাদাকালো। যে দেশে বা অঞ্চলে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কম সেখানে দলের নাম বা প্রার্থীর নাম পড়তে না জানলে কিভাবে ভোট দেবে মানুষ?
নৌকা, ধানের শীষ, অথবা লাঙ্গল— এই তিনটি শব্দ শুনে মাথায় কোন বিষয়টা ঘুরপাক খাচ্ছে? যদি ভুল না করি সবাই এই তিনটি শব্দের আক্ষরিক অর্থ না ভেবে অন্য কিছু ভাবছেন। মানে নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বললেই কি ফুটে ওঠে আমাদের মানুষপটে? তা নিয়েই এই আজকের আলোচনা।
নির্বাচনী প্রতীকের আবির্ভাব
প্রথমেই জানার চেষ্টা করি, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রতীকের আবির্ভাবের ইতিহাস আর প্রেক্ষাপট। আপনাদের জন্য একটি প্রশ্ন— নির্বাচনের দিন ভোটাররা ব্যালট পেপারে কি দেখে ভোট দেন? প্রার্থীর ছবি নাকি দলীয় প্রতীক?
সবার উত্তর নিশ্চয়ই প্রতীক। তাহলে বুঝে নিন রাজনৈতিক দলের দলীয় নির্বাচনী প্রতীক সামান্য কোন বিষয় নয়, তাদের দীর্ঘ পথপরিক্রমার সাক্ষী এই প্রতীক।
শুরুটা আমাদের বাংলাদেশ দিয়েই। পাকিস্তান আমল থেকেই এই ভূখণ্ডে নৌকা, ধানের শীষ আর লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন হয়ে আসছে। এই তিন প্রতীকের প্রথমটি অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রেক্ষাপট সবচেয়ে পুরনো।
সেই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন থেকেই মূলত ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর আওয়ামী মুসলিম লিগ, কৃষক শ্রমিক লীগ, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টি মিলে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। আর এই যুক্তফ্রন্টই প্রথম নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোটের লড়াই শুরু করে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে।
আওয়ামীলীগ এর প্রতীক নৌকা যেভাবে এলো
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকে নিরঙ্কুশ জয় পায়। সেই থেকেই দলটি নৌকা প্রতীকেই নির্বাচন করে চলেছে। নৌকাকে নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণ কি?
ইতিহাসবিদদের মতে, তৎকালীন বাংলায় নদীপথ ছাড়া চলাচলের উপায়ই ছিল না। নদীতে পাল তোলা নৌকায় চলতো গানচর্চা। ঐতিহাসিকভাবেই এই চিত্র গোটা অঞ্চলের মানুষের মনে গেঁথে আছে।

ইতিহাসবিদরা মনে করেন, তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মাওলানা ভাসানী যেহেতু গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন আর নৌকা ছিল সে সময় গ্রামীণ জীবনের অংশ, সে কারণেই হয়তো তারা নির্বাচনের প্রতীক হিসেবে নৌকাকে বেছে নিয়েছিলেন।
ধানের শীষ বিএনপির প্রতীক হওয়ার রহস্য
ধানের শীষ কিভাবে বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক হলো? ১৯৭৯ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো বিএনপির দলীয় প্রতীক হিসেবে ধানের শীষ ব্যবহার করেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান।
যদিও পাকিস্তান আমলে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর প্রতীক ছিল ধানের শীষ। পরে ন্যাপের একটি বড় অংশ বিএনপির সাথে যোগ দিলে দলটির ধানের শীষকে প্রতীক হিসেবে বেছে নেয়।

গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, নৌকার মতো সার্বজনীন গ্রাম বাংলার একটি প্রতীক বেছে নেওয়ার তাগিদ থেকেই ধানের শীষকে বেছে নেন বিএনপির তৎকালীন নেতারা।
জাতীয় পার্টি লাঙ্গল কেন নিল!
শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের অভিভক্ত ভারতের কৃষক পার্টির প্রতীক ছিল লাঙ্গল। পরে এই প্রতীক নিয়ে নেন আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এই প্রতীকে নির্বাচন করে দলটি। অবশ্য লাঙ্গল প্রতীকটি এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির প্রতীক হয়ে ওঠে আরো পরে, যখন আতাউর রহমান খান এরশাদের প্রধানমন্ত্রী হন। তখন তার কাছ থেকেই লাঙ্গল প্রতীকটি গ্রহণ করে জাতীয় পার্টি।
প্রতীক পাল্টানোর ইতিহাস
ভারতের কংগ্রেস, বিজেপির মতো দলগুলো বেশ কয়েকবার নিজেদের নির্বাচনী প্রতীক পাল্টেছে। কংগ্রেসের প্রথম প্রতীক ছিল জোড়া বলদ এবং জোয়াল। কংগ্রেস ভাঙার পর ইন্দিরা গাঁধীর কংগ্রেসের প্রতীক হয় গাই-বাছুর। ১৯৭৭ সালে তাদের স্থায়ী প্রতীক হয় হাত। ক্ষমতাশালী বিজেপির প্রতীকের ইতিহাসও অনেকটা একই রকম।
বিজেপি যখন জনসঙ্ঘ পার্টি ছিল তখন তাদের প্রতীক ছিল হাতওয়ালা প্রদীপ। ১৯৭৭ সালে জনতা পার্টির সাথে মিশে যাওয়ার পর লাঙ্গল কাঁধে কৃষকের প্রতীক হিসেবে বেছে নেয় দলটি। আর ১৯৮০ সালে বিজেপির স্থায়ী প্রতীক হয় পদ্ম।
প্রতীক আসার ইতিহাস
যুক্তরাষ্ট্রের দলীয় প্রতীক নিয়ে একটা মজার বিষয় বলি। সবাই কমবেশি জানি, যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির দলীয় নির্বাচনী প্রতীক গাধা, অন্যদিকে রিপাবলিকানদের মার্কা হাতি। এই দুই প্রতীকের ইতিহাসও ১৫০ বছরের বেশি পুরনো।
১৯ শতকে দেশটিতে কার্টুন ছিল ভীষণ জনপ্রিয়। পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হত কার্টুন। বলা হয়, গাধা ও হাতি এই প্রতীক দুটো এসেছে কার্টুন থেকে। অবশ্য প্রতীক দুটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন টমাস নাস্ট নামের এক কার্টুনিস্ট। রিপাবলিকান পার্টি থেকে আব্রাহাম লিংকন প্রথমবার হাতি প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন।
অন্যদিকে আঠারোশো আটাশ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রাপ্তি হন অ্যান্ড্রু জ্যাকসন নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাকে জ্যাক এস অর্থাৎ গাধা বলে ডাকতো। ওই সময় একজন কার্টুন শিল্পী জ্যাকসনের মাথাটা একটি গাধার শরীরের উপর বসিয়ে কার্টুন আঁকে যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
নির্বাচনী প্রতীকে রং এর ভূমিকা
সেই গাধাকেই নির্বাচনী প্রতিক হিসেবে বেছে নেন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রুজেকশন। ব্রিটেন এর সিস্টেমটা আবার অন্যরকম নির্বাচনে তারা প্রত্যেকের পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট রং দিয়ে দলের ব্রান্ডিং করে নির্দিষ্ট ওই রং দেখেই দল ও প্রাপ্তি কে চিনে নেয় ভোটাররা।
যেমন কঞ্জারভিটির পার্টির দলিয় রঙ নীল আর নীল রঙের ইতিহাসও বেশ পুরনো যুক্তরাজ্যের জাতীয় প্রতাকার রঙ থেকেই তারা নীল রঙটি বেছে নিয়েছে। আবার লেবার পার্টির দলিয় রঙ লাল সেই ফরাসি বিপ্লব থেকেই বামপন্থী লেবার পার্টি এই রঙ নিয়ে দলের ব্র্যান্ডিং করে আসছে।
এছাড়াও দেশটিতে হলুদ রং ব্যবহার করে স্কোয়াডীস ন্যাশনাল পার্টি। আর লিভারেল ডেমোক্রেডটা ব্যবহার করে কমলা।
নির্বাচনে প্রতীকের ব্যবহার চালুর কারণ
এই যে নির্বাচনের প্রতীক নিয়ে বলছি নির্বাচনের এই প্রতীক আসলে আসলো কিভাবে সংক্ষেপে সেটা একটু বলি নির্বাচনের প্রতীকের সাথে নিরক্ষরতার একটি সম্পর্ক আছে প্রায় সব কটি দেশে যখন থেকে নির্বাচন পদ্ধতি চালু হয় তখন শিক্ষিত মানুষ ছিল কম। তখন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, দলের নাম বা প্রার্থীর দাম পড়তে না জানলে কিভাবে ভোট দেবে মানুষ?
সেই চিন্তা থেকে ব্যালটে সহজেই চেনা যায় এমন সব জিনিসকেই প্রতীক হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। প্রতীকের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় নির্বাচন কমিশন খেয়াল রাখে সেটি হলো সহজে আঁকতে পারার বিষয়টি। আর এ কারণেই বেশিরভাগ দেশেই প্রতীক দেয়া হয় সাদাকালো যাতে প্রার্থীরা সহজে আঁকতে বা ছাপতে পারেন।
দলীয় প্রতীক যতই দলকে রিপ্রেজেন্ট করুক ভাবমূর্তি রক্ষার দায়িত্ব কিন্তু সেই দলের রাজনীতিবিদদের হাতে। আজ এ পর্যন্তই। আশা করছি আপনার ভালো লেগেছে। এই রকম আরও নিত্যনতুন আপডেট তথ্য পেতে আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন।
এই বিষয়ে আরও সবিস্তারে জানতে চাইলে নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেন-
1 Comment
Pingback: ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া - প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফল! - NiceTrix