গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। এআই এখন শুধু গবেষণায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি এখন বিশ্ব অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রতিরক্ষায় এমনকি দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়ও বিপ্লব ঘটাচ্ছে।
আমরা সবাই ইতিমধ্যে জেনে গেছি যে ভবিষ্যতের পৃথিবী হবে এআই নির্ভর। তাই আমরা যত বেশি এআইয়ের সাথে নিজেদের আপডেট করতে পারবো, ততই প্রযুক্তির দিক থেকে এগিয়ে থাকতে পারবো।
যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে শুরু করে ভারত পর্যন্ত সবাই দৌড়ে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করছে। দেশগুলোর মধ্যে চলছে প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রতিযোগিতা।
যুক্তরাষ্ট্রের জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন ওপেনএআই, গুগল, মাইক্রোসফট, মেটা এবং অ্যামাজন ইতিমধ্যেই বিলিয়ন ডলারের বেশি ইনভেস্টমেন্ট করেছে এআই গবেষণা ও অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্টে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটি এবং গুগলের জেমিনি বর্তমান বিশ্বে আলোড়ন তুলছে। যদি আমরা চ্যাটজিপিটির কথা চিন্তা করি, চ্যাটজিপিটি হচ্ছে একটি উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চ্যাটবট, যা মানুষের মতো করে ভাষা বুঝে এবং উত্তর দিতে পারে। এটি ওপেনএআই তৈরি করেছে এবং এটি বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর থেকে শুরু করে লেখালেখি, কঠিন অনুবাদ এমনকি সৃজনশীল লেখাও করতে সক্ষম।
শিক্ষার্থী, প্রোগ্রামার, লেখকসহ নানা পেশার মানুষ চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে সহজে ও দ্রুত সমাধান পাচ্ছেন। এটি বাংলা ভাষাতেও কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে, যা বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য একটি বড় সুবিধা। এটি বর্তমানে আশিটিরও বেশি ভাষা বুঝতে সক্ষম এবং সেই ভাষাতেই আপনাকে উত্তর দিতে সক্ষম।
অন্যদিকে জেমিনিও হচ্ছে গুগলের তৈরি আরেকটি এআই ভিত্তিক চ্যাটবট, যা চ্যাটজিপিটির মতোই ভাষা বোঝা, বিশ্লেষণ ও উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ। বর্তমানে গুগল তাদের নতুন প্রোডাক্ট ভিউ ৩ লঞ্চ করেছে, যেটি জেমিনির সাথে ইন্টিগ্রেট করা হয়েছে এবং ভিউ ৩-এর কাজ হচ্ছে খুবই সূক্ষ্ম এবং দারুণ রিয়েলিস্টিক ভিডিও জেনারেট করা।
আপনারা যদি ভিডিওগুলো দেখেন, যেগুলো ভিউ ৩ দ্বারা তৈরি করা হয়েছে, অবাক হবেন যে একটি এআই কীভাবে এই ধরনের ভিডিও তৈরি করতে পারে। সুতরাং আপনারা বুঝতেই পারছেন, আমেরিকা আসলে এআই ফিল্ডে কতটা এগিয়ে আছে।
চীনও পিছিয়ে নেই। দেশটি এআই শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। এমনকি ৬ বছরের শিশুদের জন্য এআই শিক্ষা পাঠ্যবই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চীনের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব এআইয়ের নেতৃত্বে পৌঁছানো। এছাড়া চীনা এলএলএম ডিপসিক ইতিমধ্যে চ্যাটজিপিটির মতো মডেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে এবং তারা এই প্রতিযোগিতায় দারুণ করছে।
ভারতও এআই ব্যবহার করছে কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, প্রশাসন ও শিক্ষায়। দেশটি সরকারি ও বেসরকারি খাতে যৌথ উদ্যোগে এআই স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে তুলছে। ভারতের তৈরি এআই টুল কমপ্লেক্সিটি আজকে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত হচ্ছে।
বিশ্বের অগ্রগতিতে শক্তিশালী আরো চারটি দেশের নাম হচ্ছে কানাডা, জাপান, ইসরাইল এবং সাউথ কোরিয়া। কানাডাকে বিশ্ব এআই গবেষণার গ্লোবাল হাব বলা হয়ে থাকে। বিশ্বের যারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণায় এগিয়ে, তাদের মধ্যে কানাডা বিশ্বসেরা। এমনকি এআই-এর গডফাদার জিওফ্রে হিন্টন কানাডার টরন্টোতেই এআই গবেষণার পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছেন।
ইসরাইল এআই ব্যবহার করছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাতে—সাইবার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে। অন্যদিকে জাপান এবং সাউথ কোরিয়াকে রোবোটিক্স এবং এআই অটোমেশনের পাথফাইন্ডার বলা হয়ে থাকে।
সাউথ কোরিয়ান বিগ টেক কোম্পানি স্যামসাং, এলজি এবং হুন্ডাই রোবোটিক্স-এর মতো জায়ান্টরা এআই ইনোভেশনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। জাপান বরাবরই রোবোটিকসে অগ্রগামী, আর এখন তারা এআই যুক্ত করে তৈরি করছে হিউম্যানয়েড ও হেলথ-রিলেটেড রোবট।
এছাড়া ইউএই, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোও এআইয়ের সাথে খুব দ্রুত এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? বাংলাদেশ কি এআইয়ের যুগে তাল মেলাতে পারছে? উত্তরটা হচ্ছে—না।
বাংলাদেশ এখনো এআই বিপ্লবের প্রাথমিক ধাপে রয়ে গেছে। যদিও বাংলাদেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এআই ও মেশিন লার্নিং নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে, শিক্ষাক্রমেও যুক্ত হচ্ছে এআই বিষয়ক পাঠ। পাশাপাশি কিছু স্টার্টআপ ইতিমধ্যেই এআই ভিত্তিক প্রোডাক্ট ও সলিউশন তৈরি করতে শুরু করেছে।
তবে বাংলাদেশের জন্য কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে, যেমন পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর ঘাটতি, দক্ষ টেক ট্যালেন্টের অভাব, রিসার্চ ফান্ডিং ও ইনভেস্টমেন্টের সংকট। তবে যদি সরকারি এবং বেসরকারি খাত একসঙ্গে ফান্ডিং, স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম এবং গবেষণায় উৎসাহ দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশও এই প্রযুক্তিগত বিপ্লবে দৃঢ়ভাবে অংশ নিতে পারবে।
এই যাত্রা দীর্ঘ হলেও সঠিক পরিকল্পনা, নীতি নির্ধারণ এবং ইচ্ছা থাকলে বাংলাদেশের তরুণরাই হতে পারবে আগামী দিনের এআই রেভোলিউশনের অগ্রদূত।